জৈবিক প্রজাতি মতবাদ ও এর সীমাবদ্ধতা



 প্রজাতি: দুই বা ততোধিক জীবের মধ্যে আন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে উর্বর সন্তান উপাদানে সক্ষম কিন্তু একই রকম আঙ্গিক লক্ষণ বিশিষ্ট অন্যান্য জীব থেকে জনন সূত্রে বিচ্ছিন্ন তাদেরকে প্রজাতি বলে। প্রজাতি সম্পর্কে বিভিন্ন সময়ে শ্রেণিবিন্যাসে বিজ্ঞানীরা ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যের উপস্থাপনা করেছেন, যা প্রজাতি প্রত্যয় নামে পরিচিত।


প্রজাতির ধারণা সম্পর্কিত জীবতাত্ত্বিক মতবাদ/ বায়োলজিক্যাল মতবাদের ব্যাখ্যা নিচে দেওয়া হলো:

প্রজাতির জীবতাত্ত্বিক মতবাদ (Biological species concept): যে মতবাদে স্বতন্ত্র জীবের জনগোষ্ঠী ও তার সংখ্যায়ন ও জিনভান্তার


বিবেচনায় নিয়ে প্রজাতি সম্পর্কিত যে মতবাদের অবতারণা করা হয়, তাকে প্রজাতির জীবতাত্ত্বিক মতবাদ বলা হয়। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে শ্রেণিতাত্ত্বিকগণ এ ধারণা পোষণ করেন। এক্ষেত্রে প্রজাতি সম্পর্কিত ধারণা বিশ্লেষণে পাওয়া তিনটি বৈশিষ্ট্য নিম্নে বর্ণিত হলো:


(ক) প্রজাতি একটি প্রজননিক সম্প্রদায় (Species is a reproductive community): যেকোনো ধরনের প্রজাতির মধ্যে সংশ্লিষ্ট সদস্যরা প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বেচ্ছায় যৌন মিলনের মাধ্যমে যেমন বংশ বিস্তার করতে পারে তেমনি অন্য পপুলেশন বা জনগোষ্ঠীর সাথে যৌন মিলনে বংশ বিস্তারে ব্যর্থ হয়।


(খ) প্রজাতি একটি বাস্তুগত একক (Species is an ecological unit): প্রজাতি বা পপুলেশনের সদস্যদের মধ্যে যেমন ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য দেখা যায় তেমনি পরস্পরের মধ্যে প্রভেদ পরিলক্ষিত হয়। একটি বাস্তুতান্ত্রিক পরিবেশে একই প্রজাতির সদস্য বা একই সাথে বসবাস করে তাই প্রজাতিকে একটি বাস্তুসংস্থানগত একক (Unite) হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তবে একই পরিবেশে বিচরণকারী অন্যান্য জনগোষ্ঠী থেকে অবশ্যই এদের স্বাতন্ত্র্য বোধের পরিচয় পাওয়া যায়।


(গ) প্রজাতি একটি জেনেটিক একক (Species is a genetic Unit): প্রজাতি বা একটি পপুলেশনের সদস্যদের মধ্যে আন্তঃপ্রজননের মাধ্যমে জিনের আদান-প্রদান সংঘটিত হয়। তাই বলা যায় প্রজাতি মূলত একটি বৃহদাকার জিনভাণ্ডার। সার্বিক বিবেচনায় দেখা যায় যে, প্রজাতি বা পপুলেশনের সদস্যরা বিশাল জিন ভান্ডারের সামান্যতম অংশ। প্রজাতির সদস্যরা এ জিন ভাণ্ডারের জিনের অংশ বিশেষ। এর বাহক বা আধার যা স্বল্পকালের জন্য তারা বহন করে।


উপর্যুক্ত তিনটি ধারণা থেকে মায়ার (১৯৪২) বলেন যে, প্রাকৃতিক জীবগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে আন্তঃপ্রজননে সক্ষম এবং অন্যান্য জীবগোষ্ঠীর সাথে প্রাকৃতিকভাবে প্রজননে অপারগ তাদেরকে প্রজাতি নামে অভিহিত করেন।

আর্নেষ্ট মায়ার নিম্নে বর্ণিত বৈশিষ্ট্যগুলো প্রজাতি সম্পর্কে উল্লেখ করেন-


(i) অভিন্ন জিন ভাণ্ডারের যে আধারে জিনের মুক্ত প্রবাহ প্রজননের মাধ্যমে অব্যাহত থাকে তাকে প্রজাতি বলা যায়।


(ii) পরিবর্তিত পরিবেশে অভিযোজিত হওয়া প্রচেষ্টা প্রজাতির মধ্যে পরিলক্ষিত হয়য়। (iii) যৌন প্রজননের মধ্যে যে জীবগোষ্ঠীর সদস্যরা জিন বিনিময় করতে সক্ষম তারাই প্রজাতি।


(iv) অভিযোজন ও বিবর্তন ধারায় নতুন প্রজাতি সৃষ্টির ক্ষমতার অধিকারী কোনো জনগোষ্ঠীর সদস্য প্রজাতি নামে পরিচিত।


(v) প্রজাতি অবশ্য নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ধারণা করে।


মূলত দেখা যায় জীবতাত্ত্বিক মতবাদ অনুযায়ী প্রতিটি প্রজাতি একটি বৃহৎ জিন ভাণ্ডারের সংরক্ষিত ক্ষুদ্র বংশ। একই জিন ভাণ্ডারের জিনগুলোর মধ্যে বিনিময়ের মাধ্যমে সামঞ্জস্যপূর্ণ সংমিশ্রণ ঘটে। এর ফলে জিনগুলো বিন্যস্ত হয় ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের দ্বারা অভিযোজিত হয়। সুতরাং বলা যায় বিবর্তনের ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় প্রজাতি হচ্ছে গতিময় (dynamic) ও বহুমাত্রিক গুণাবলির অধিকারী।


প্রজাতির জীবতাত্ত্বিক মতবাদের ব্যবহারিক অসুবিধা বা সীমাবদ্ধতা (Disadvantage or limitation of application of biological species concept): প্রজাতির জীবতাত্ত্বিক মতবাদ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সৃষ্ট অসুবিধাগুলো মূলও সীমাবদ্ধতা হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব সীমাবদ্ধতা নিম্নে বর্ণিত হলো- ১. উপযুক্ত তথ্যে অপ্রতুলতা (Lack of suitable information): কোনো প্রজাতির অন্তর্গত কোনো সদস্যের যৌন দ্বিরূপতা, বয়সের পার্থক্য,


জীবন চক্রের বিভিন্ন দশা, বহুরুপতা ইত্যাদি কারণে আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যে পার্থক্য দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় না যে জীবটি পৃথক


প্রজাতি না পরিচিত প্রজাতির প্রকরণ (variation) জাত রূপ। এসব ক্ষেত্রে যথেষ্ট তথ্য উপাত্ত সংগৃহীত না করে এসব সমস্যা সমাধান করা যায় না। ২. একজনিত্রিক জনন (Uniparental reproduction): যে প্রজননে স্বনিষেক, অপুংজনি, অঙ্গজ প্রজনন ইত্যাদির মাধ্যমে বিপরীত লিঙ্গের সাহায্য ছাড়াই প্রজনন সম্পন্ন হয়, তাকে একজনিত্রিক জনন বলা হয়। এসব ক্ষেত্রে দ্বি-জনিত্রিক জননের মতো জিন বিনিময় হয়। ফলে প্রজাতি একটি প্রজননিক সম্প্রদায় বিষয়টি প্রযোজ্য হয় না।


৩. বিবর্তনীয় মধ্যস্থতা (Evolutionary intermediacy): স্থানীয়ভাবে প্রজনন বিচ্ছেদ দিয়ে প্রজাতি চিহ্নিত করা যায়। তবে স্থান ও কালের পরিধি প্রসারিত হলে এমন প্রাণী পাওয়া যেতে পারে যা মূল প্রজাতি থেকে ভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য-ধারণ করে। ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যায় যে বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হলে প্রজনন বিচ্ছেদ নাও ঘটতে পারে। এভাবে বিবর্তনের মধ্য অবস্থার কারণে উদ্ভূত সমস্যাগুলো নিম্নে আলোচনা করা হলো-


(ক) আঙ্গিক বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ছাড়াই প্রজনন বিচ্ছেদ (Acquision of reproductive isolation without equivalent morphological change): যে প্রাণীর অঙ্গসংস্থানিক পার্থক্য খুব নগণ্য কিন্তু প্রজননগত দিক থেকে বিচ্ছিন্ন তাদ্রেরকে সিবলিং প্রজাতি নামে আখ্যায়িত করা হয়। প্রকৃতিতে বিবর্তনের ধারায় প্রজাতি সৃষ্টির মধ্য অবস্থায় এ ধরনের প্রাণীর উদ্ভব ঘটে। এসব বিষয় প্রজাতির জীবতাত্ত্বিক মতবাদের সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।


(খ) প্রজনন বিচ্ছেদ ব্যতীত আঙ্গিক পার্থক্য (Morphological difference without reproductive isolation): একই ভৌগোলিক অঞ্চলে বসবাসকারী দুটি জীবগোষ্ঠীর সদস্যদের বৈশিষ্ট্যগত বৈসাদৃশ্য থাকার সঙ্গে প্রজনন বিচ্ছেদ ঘটে না। এদের মিলনে অভিন্ন ক্ষেত্রিক সংকরায়ন বা Sympatric hybridization ঘটে। পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জে Cerion নামক শামুকে এ ধরনের ঘটনা দেখা যায়। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে অঙ্গসংস্থানগত পার্থক্য সৃষ্টি হলেও প্রজনন বিচ্ছিন্নতা অর্জিত হয়নি এমন প্রজাতির জীবতাত্ত্বিক মতবাদের প্রতিটি প্রজাতি নিজ বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র উক্তিটি ব্যতিক্রম বলা যায়।


(গ) অন্তরণে বিঘ্ন সৃষ্টি (Breakdown of isolation): পর্যবেক্ষণে দেখা যায় ক্ষেত্র বিশেষে প্রজনন বিচ্ছেদ ব্যবস্থার বিলুপ্ত হয়ে নিকট সম্পর্কীয় প্রজাতির মধ্যে যৌন মিলন শেষে সংকরের সৃষ্টি হয়। এরূপ ব্যাপক সংকর সৃষ্টি হলে প্রজাতি একটি প্রজননিক সম্প্রদায় উক্তিটি প্রযোজ্য হয় না।


(ঘ) অর্থ-প্রজাতি (Semispecies): প্রজাতির যেসব সদস্য উপ-প্রজাতি ও প্রজাতির মধ্যবর্তী বৈশিষ্ট্য ধারণ করে তারা অর্ধ-প্রজাতি নামে পরিচিত হয়। সাধারণত ভৌগোলিক বিস্তারের প্রেক্ষিতে সৃষ্ট চক্রাকার অধিক্রমণ (Circular ovatap) ও প্রান্তিক সীমার কতিপয় প্রাণী এমন বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয় যেন এদের প্রজাতি হিসেবে বিবেচনা পরিবর্তে অর্থ-প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব অর্ধ-প্রজাতি জীবতাত্ত্বিক মতবাদে বাধা সৃষ্টি করে।

Leave a Comment